অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, শুক্রবার, ২৭শে জুন ২০২৫ | ১৩ই আষাঢ় ১৪৩২


ঘুরে আসুন প্রাকৃতিক লীলাভূমি মনপুরা দ্বীপ থেকে


বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৩০শে জানুয়ারী ২০২২ দুপুর ০১:২৯

remove_red_eye

৭০৬

এম শরীফ আহমেদ।। বাংলাদেশের বৃহওম দ্বীপ ভোলা জেলার মুল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। উত্তাল মেঘনার কোল ঘেসে জেগে ওঠা তিন দিকে মেঘনা আর একদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরুপ সাজে সজ্জিত লীলাভূমি মনপুরা। এখানে না আসলে বোঝাই যাবেনা সবুজের দ্বীপ মনপুরায় কি সৌন্দর্য লুকায়িত আছে। পর্যটনের কি অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে পুরানো এ দ্বীপে। প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই দ্বীপটি। পর্তুগিজরা এই দ্বীপে বসবাস করছিলো।

এখানে সকাল বেলার সুর্য যেমন হাঁসতে হাঁসতে পূর্বদিকে ডিমের লাল কুসুমের মত উদিত হতে দেখা যায়, তেমনি বিকেল বেলাতেও আকাশের সিঁড়ি বেয়ে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে পশ্চিম আকাশে মুখ লুকায়।মনপুরাতে সুর্যোদয় ও সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা যায়। ভোলা জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিন পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে মেঘনার মোহনায় চারটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। মনপুরা উপজেলা প্রায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস।

 

৩৭৩.১৯ বর্গকিলোমিটার এ দ্বীপে আরো আছে দক্ষিণা হাওয়া সীবিচ, ল্যান্ডিং স্টেশন,  হরিণের অভয়াশ্রম ও চৌধুরী প্রজেক্ট । মনপুরা দ্বীপটিকে নিয়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে ‘মনপুরা’ নামের চলচ্চিত্র নিমির্ত হওয়ার পর থেকে এই দ্বীপটির নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।তখন থেকেই  দ্বীপটি মানুষের কাছে বেশ পরিচিতি লাভ করে।  মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশনটি নদীর ৫০০ মিটার ভেতরে তৈরি করা। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু পর্যটকরা না, স্থানীরাও সময় কাটাতে আসে এখানে। রাতে এখানে বসলে, মনে হবে আপনি মেঘনা নদীর গভীরে ভাসছেন। কারণ, তখন আপনার চারদিকে থাকবে পানি আর আপনি বসে থাকবেন পানির সামান্য উপরে। নদীর পানির স্রোত আর ঢেউয়ে মাঝে মাঝে স্টেশনটি কেঁপে উঠে, তখন মনে হবে এই বুঝি নদীতে ভেসে গেলাম। এটা এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অনুভূতি।

সবুজ -শ্যামল প্রকৃতি, মায়াবী হরিণ,কেওড়া বন ঘেরা মনপুরায় পর্যটক আকর্ষণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে দক্ষিণা হাওয়া সীবিচ।মনপুরার এখন প্রধান আকর্ষণ এই সীবিচ। এখানে বঙ্গোপসাগরের আঁচড়েপড়া ঢেউ,নির্মল বাতাস যেকাউকে মুহুর্তেই আকৃষ্ট করে ফেলে। বীচে রয়েছে সারি সারি বেঞ্চ এবং ছাতা।এছাড়াও এখানে রয়েছে ছনের তৈরি ঘর,বৈঠক খানা,হ্যামক এবং নিরাপত্তার জন্য লাইফজ্যাকেট।কিছুসময় বসলে আপনি অজান্তেই হারিয়ে যাবেন এখানের সৌন্দর্য দেখে।দীপের দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে রহমান পুরেই এর অবস্থান।দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত এই সীবিচ।

 

দ্বীপে  উত্তর সাকুচিয়ার  আলমবাজারে রয়েছে একটি হরিণের অভায়াশ্রম। জোয়ারের সময় হরিণগুলো প্রধান সড়কের কাছে চলে আসে। স্থানীয়রা জানায়, হরিণের পাল যখন রাস্তা পার হয় তখন ২/৩ মিনিট পর্যন্ত মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে হয়। আপনার ভাগ্যে থাকলে আপনিও দেখা পেয়ে যেতে পারেন হরিণের পালের।

দ্বীপে চৌধুরী প্রজেক্টে আছে লেক। লেকের পাড় জুড়ে সারি সারি লাইনে  নারিকেল গাছ। পাড়ের একপাশে লেক অন্য পাশে মেঘনা। বিকালের সময়টা খুবই চমৎকার কাটবে আপনার এখানে। যদিও মেঘনার ভাঙ্গনে ও ঘূর্ণিঝড় সিডর,আইলা, কোমেন, মোরার আঘাতে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রজেক্টটি। তবুও সৌন্দর্য রয়েছে চৌধুরী প্রজেক্ট। এছাড়া বাধেরহাটের পাশে রয়েছে কয়েকটি মাছ চাষের দিঘি ও বিশাল কেওড়া বাগান।

যানবাহনঃ
এ দ্বীপের প্রধান যানবাহন হচ্ছে মোটরসাইকেল। এছাড়া রয়েছে টেম্পু গাড়ি,অটোরিকশা, বোরাক। সাইক্লিং করার জন্য এই দ্বীপ খুবই উপযোগী। মোটরসাইকেলে ৭০০/৮০০টাকা ভাড়ায় পুরো মনপুরা অনায়াসে ঘুুুুরতে পারবেন। 

কখন যাবেনঃ
শীতকাল মনপুরা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়।

কি খাবেনঃ
মনপুরা দ্বীপে শীতকালে হাসেঁর মাংস ভূনা খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও মহিষের দুধের দধি,খেজুর রস,খেজুরের গুড়, ইলিশ, কোরাল, বোয়াল ও গলদা চিংড়ি,শোল, শিং, কই বেশ পরিচিত। মেঘনা নদীর টাটকা ইলিশ ও মহিষের কাঁচা দুধ খুবই সুস্বাদু। হোটেলে কম খরচে খেতে পারবেন। 

যা যা দেখবেনঃ
সূর্যোদয়,সূর্যাস্ত, ম্যানগ্রোভ প্রজাতির হাজার হাজার গাছ,মাছ চাষের দিঘি,দ্বীপের দক্ষিণা হাওয়া সীবিচ এ  কক্সবজারের মতো কিছুটা আভাস,সবচাইতে আকর্ষণীয় মনপুরায় প্রত্যক্ষভাবে হরিণের ছুটাছুটি দেখা যায়।

কিভাবে যাবেনঃ
মনপুরা বিছিন্ন দ্বীপ হওয়াতে যখন তখনই আপনি যেতে পারবেন না। তাসরিফ -১ও তাসরিফ -২। এছাড়া এমভি ফারহান-৩/এমভি ফারহান-৪ নামে দুটি বিলাশ বহুল লঞ্চ রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ১০নাম্বার প্লাটুন থেকে প্রতিদিন বিকাল পাঁচটায় হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। এই লঞ্চ করে আপনি সকাল ৫টা নাগাদ মনপুরা দ্বীপ পৌঁছতে পারবেন। যাত্রা পথে লঞ্চ থেকেও সূর্যোদয় দেখতে ভুলবেন না। সময় লাগবে ১৩/১৪ ঘন্টা। লঞ্চের ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৪৫০ টাকা,সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১০০০-১২০০ টাকা। আবার ফেরার পথে মনপুরা রামনেওয়াজ লঞ্চঘাট থেকে দুপুর ২টায় এবং আড়াইটায়  লঞ্চ দুটি ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। 

 ঢাকা থেকে বরিশাল  ভোলা হয়েও যেতে পারেন।তবে এতে অনেক ঝামেলা। যদি আপনার বরিশাল, ভোলা বেড়ানো বা অন্য কোনো কাজ না থাকে তাহলে আপনি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে সরসরি মনপুরার লঞ্চে উঠে যাবেন। খুব আরামে আপনি গন্তব্যে পৌঁছতে  পারবেন। ভোলা থেকে আপনি বিভিন্ন উপায়েে মনপুরা যেতে পারেন।এছাড়া ঢাকা টু মনপুরার লঞ্চ দুটি ভোলার জংশন ঘাটে রাত ১১টায়,ইলিশা  ফেরীঘাটে রাত সাড়ে১১ টায়,দৌলতখান ঘাটে রাত ১টায়,হাকিমুদ্দিন ঘাটে রাত সোয়া ২টায়, সরাজগঞ্জ ঘাটে রাত পোনে ৩টায়, তজুমুদ্দিন ঘাটে রাত পোনে ৪টায় থামে। এসব ঘাট থেকেও আপনি মনপুরার যেতে পারেন।

 অন্যদিকে ভোলার  তজুমদ্দিন ঘাটের সি-ট্রাকে মনপুরায় যাওয়া যায়। সি-ট্রাকটি তজুমদ্দিন থেকে ছাড়ে প্রতিদিন বিকাল ৩টায় আর মনপুরা থেকে ছাড়ে সকাল ১০টায়। অপরদিকে চরফ্যাশনের বেতুয়াঘাট থেকে মনপুরার জনতা বাজার রুটে দৈনিক দুটি ছোট লঞ্চ চলাচল করে।এ লঞ্চ দুটি প্রতিদিন  দুপুর ১২টা ও বিকাল ৩টায় বেতুয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে আর মনপুরা থেকে ছেড়ে আসে সকাল ৯টায় ও দুপুর ২টায়।প্রতিদিন শত শত মানুষ এই রুটে মনপুরায় আসা-যাওয়া করছেন। তবে বর্ষায় এই রুটে যাওয়া অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। যাদের আগে  কখনো নদীপথে বা ট্রলারে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই  তারা কখনো এ রুটে যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন না৷। কারণ এখানের নদী   খুবই উত্তাল ।  ছোট এই লঞ্চগুলো চলার সময় খুব বেশি দুলতে থাকে এতে আপনি ভয়ে বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। তখন আনন্দের কথা ভুলে গিয়ে মন খারাপ করে  কাঁদতে শুরু করবেন। 

কোথায় থাকবেনঃ
থাকার জন্য মনপুরা দ্বীপে সরকারি  ডাকবাংলো, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবণ  আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সরকারি ডাকবাংলো ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবণে  থাকতে পারবেন। তবে এগুলো বেশিরভাগ সময় বুুুক করা থাকে।আপনি থাকতে চাইলে আগেই বুুুকিং দিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া দ্বীপের প্রাণকেন্দ্রে হাজিরহাটে মালিকানা আবাসিক হোটেল সিমা,মাহি,হানিফ , আরাফ, ওহি, ,রাহি রয়েছে।অন্যদিকে দ্বীপের দক্ষিণা হাওয়া সীবিচ কাছাকাছি সিরাজগঞ্জ বাজারে  রয়েছে হোটেল "সমুুদ্র বিলাস" । এতে অল্প খরচে থাকতে পারবেন।

আবাসিক হোটেল ছাড়াও ক্যাম্পিং করে থাকতে পারেন। ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ জায়গা মনপুরা। একটা ভালো জায়গা দেখে তাবু ফেলে নিন। পড়শীদের সাথে রফা করে রান্নার আয়োজন করতে পারবেন। দক্ষিণা হাওয়া সীবিচ এ আপনি ক্যাম্পিং করতেে পারেন।রাতে বঙ্গপসাগরের কলকলধ্বনি, নির্মল বাতাস এবং সকাল বেলার উদিত ডিমের কুসুমের মতো সূর্য দেখলেই আপনি চমকে উঠবেন।

লেখকঃ এম শরীফ আহমেদ 

(তরুণ উদ্যোক্তা,স্বেচ্ছাসেবী ও সাংবাদিক)