অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, শুক্রবার, ২৭শে জুন ২০২৫ | ১২ই আষাঢ় ১৪৩২


ভোলায় কলেজ ছাত্রদল নেত্রী সুকন্যার রহস্যজনক মৃত্যু: সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবিতে বিক্ষোভ-মিছিল


বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৪শে জুন ২০২৫ সন্ধ্যা ০৭:৫২

remove_red_eye

৫৪

বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক : ভোলা সরকারি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অনার্স ৩য় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী ও কলেজ ছাত্রদলের নেত্রী সুকন্যা আক্তার ইস্পিতা লঞ্চ থেকে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এলাকায় নানা আলোচনা ও গুঞ্জন চলছে। এই ছাত্রী কি আত্মহত্যা করেছে নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে। না কি আজানা কোন কারণে আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে। এমন নানা প্রশ্ন উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে 
সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সুকন্যার মৃত্যু রহস্য উদঘাটন ও প্রকৃত দোষী হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবিতে আজ মঙ্গলবার ভোলায় বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও রাস্তা অবরোধ করেছে কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সহ  শিক্ষার্থীরা।
স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুন সকালে ভোলা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী সুকন্যা ভোলার ইলিশা থেকে কর্ণফুলী -৪ লঞ্চে ঢাকা যাচ্ছিলেন। লঞ্চের স্টাফ এবং যাত্রীরা জানান, লঞ্চের তৃতীয় তলায় রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি মোবাইল ফোনটি তার ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে লঞ্চ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। 


এ ঘটনার পরপরই বিষয়টি নিয়ে লঞ্চযাত্রী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে ওই লঞ্চের মাস্টার ইনচার্জ মোঃ মোবারক হোসেন হিজলা থানায় ১৮ জুন একটি জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, গত ১৭ জুন মঙ্গলবার ১০টায় কর্ণফুলী-৪ লঞ্চটি ৫০০যাত্রী নিয়ে ভোলার ইলিশা ঘাট থেকে ঢাকা সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেন। পৌনে ১১টার দিকে লঞ্চের পিছন দিকে তিন তলার ছাদ থেকে একজন সলোয়ার-কামিজ পড়া মহিলা যাত্রী হিজলা থানার মাঝেরচর নামক স্থানে (টিটু-৫১ ডুবা বয়া সংলগ্ন) মেঘনায় ঝাপ দেন। তখন তার লঞ্চ ঘুরিয়ে যাত্রীকে খোঁজ করেন। তাকে না পেয়ে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এবং তাৎক্ষনিক লঞ্চের মালিকসহ কোষ্টগার্ড ও নৌ-পুলিশকে বিষয়টি সম্পর্কে জানান।
এদিকে পুলিশ জানায়, ঘটনার তিন দিন পর ২০ জুন জেলেরা নদীতে একটি লাশ ভাসতে দেখে পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে লক্ষ্মীপুরের নৌপুলিশ লাশটি উদ্ধার করে থানায় হস্তান্তর করে। পরে লাশের পরিচয় পাওয়ার জন্য পুলিশ বিভিন্ন থানায় মেয়েটির ছবিসহ সংবাদ দেয়। ২২ জুন সুকন্যার বাবা মাসুদ মিয়া ছবি দেখে লাশের পরিচয় নিশ্চিত করেন। 
ভোলা পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডে সুকন্যা আক্তারের বাড়ি। সুকন্যার মা বলেন, ১৭জুন মঙ্গলবার সকাল আটটায় বাসস্টান্ডের কাছে প্রাইভেট পড়াতে যায়। সুকন্যা সেদিন শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিল। প্রাইভেট পড়িয়ে বাসায় ফিরে আসার জন্য বলেছি। কলেজ বা কোথাও বেড়াতে গেলে বাসায় বলে যায়। ওইদিন বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথা ছিল, দেখা করে সাড়ে ১১টার দিকে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু সময়মতো না আসায় আমি ১২টার দিকে ওকে কল করি। ওর মোবাইল তখন বাজলেও ধরেনি। এভাবে পরের দিন বুধবার ৩টা পর্যন্ত কল করতে থাকি। কিন্তু কেউ কল রিসিভ করেনি। ৪টার পরে আর রিং বাজেনি। আমি শুধু না, ওর আব্বুও রিং করছে। কিন্তু কেউ কল ধরেনি। তারপর থেকে আমরা ওর স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট বাসায়, বান্ধবীদের বাসায় সর্বত্র খোঁজ করেছি। কোথাও তাঁর খোঁজ পাইনি। থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছি। চারদিন পরে জানতে পারলাম- লঞ্চ থেকে একটি মেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। তখন লঞ্চেও খোঁজ করলাম। খোঁজ করতে করতে জানলাম ওই মেয়ে আমারই সুকন্যা। এখন কি কারণে , কিভাবে , কি শত্রুতার জের ধরে কি জন্য এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটলো, আমি জানতে চাই! কেনো এ দুর্ঘটনা ঘটলো, আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি এর সুস্থ্য বিচার চাই। আমার আর কিছু বলার নাই।
সুকন্যার মা ইয়ানুর বেগম শুধু কাঁদছেন। তাঁকে পাড়া-প্রতিবেশী শান্তনা দিচ্ছেন। পাড়া-প্রতিবেশী মহিলাদের বলছেন, ‘আমার কিভাবে সব শেষ হয়ে গেলো, কল্পনা করতে পারি নাই। সবকিছু কল্পনার বাইরে। 
সুকন্যা সব সময় পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আমাকে, ওর বাবাকে আশা দিয়ে বলতো, মা তোমারে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি ঠিক ভালো একটা চাকির পাব। আমি শুধু অনার্সটা পাশ করে নিই। ও কয়েকটি প্রাইভেট পড়াত। প্রাইভেটের পাশাপাশি ও একটা চাকরি খুঁজছিল জুলুজি (প্রাণিবিদ্যা) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ভালো ফলাফল করেছে। ওর পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হোক এটা আমি চাইনি।
সুকন্যার পিতা  সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, “আমার মেয়ে কেন ঢাকাগামী লঞ্চে উঠল, তা তদন্তে বের করা দরকার। প্রশাসন মোবাইল ট্র্যাকিং ও কললিস্ট বিশ্লেষণ করলেই বিস্তারিত জানা যাবে।কেউ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে থাকলে, বা হত্যা করে থাকলে তার বিচার চাই।”
এদিকে জানাযায়, সুকন্যার পারিবারিক সিদ্ধান্তে দেড় বছর আগে বিয়ে হয়েছে। আবার স্বামী তাঁকে ৫-৬ মাস আগে পোষ্ট অফিসের মাধ্যমে তালাকনামা পাঠায়। এ নিয়ে ছেলেপক্ষের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছি, যা চলমান আছে।  


ভোলা থানার ওসি হাসনাইন পারভেজ সাংবাদিকদের জানান, ২০ জুন সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুরের নৌপুলিশ লাশটি উদ্ধার করে এবং পরিচয় না পাওয়ায় ২২ তারিখ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। এব্যাপারে লক্ষীপুর থানা পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা তাদের সহায়তা করছি।তবে এখানো কোন মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন হয়নি। তবে চেষ্টা চলছে।
এদিকে সুকন্যার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় প্রকৃত রহস্য উন্মোচন ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ভোলা কলেজ চত্বর থেকে কলেজ ছাত্রদলের আয়োজনে বিক্ষোভ মিছিলটি বের হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে ভোলা প্রেসক্লাবের সামনে তারা জড়ো হয়ে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। এছাড়া সেখানে মানববন্ধন ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বক্তব্য রাখেন, ভোলা কলেজ ছাত্রদলের সদস্যসচিব মো. ফজলুল করীম ছোটন, যুগ্ম আহবায়ক তানভীর হোসেন, আরাফাত ইসলাম ইফতি, সহপাঠী ছাত্রদল কর্মী নাইম ইসলাম আসিফ, জিদান আনবীর, কামরুল ইসলাম রাব্বী প্রমূখ। মানববন্ধন ও প্রতিবাদসভার সঞ্চালনায় ছিলেন, ছাত্রদল নির্বাহী সদস্য আব্দুস সামাদ।
এসময় বক্তারা বলেন, ভোলা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের (অনার্স) ৩য় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী ও কলেজ ছাত্রদলের সদস্য সুকন্যা আক্তার লঞ্চ থেকে পড়ে গেছে, না তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু একটি মহল সুকন্যাকে ও ছাত্রদলকে জড়িয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজেবাজে পোস্ট দিচ্ছে। আমরা ছাত্রদল এ ঘটনার সুস্ঠু তদন্ত চাই। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সুকন্যার মৃত্যুরহস্য ও দোষীদের খুঁজে বের করতে হবে। যদি কোনো অপরাধী এরসঙ্গে যুক্ত থাকে তাঁকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতএ সময় ছাত্রদল নেতারা ছাত্রদল ও সুকন্যাকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাজে মন্তব্য করা বন্ধসহ গুজব বন্ধের জন্য আহ্বান জানান।
এদিকে লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরী ঘাট নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. আজিজুল হক সাংবাদিকদের জানান, উদ্ধারের সময় মরদেহে কালচে দাগ ছিল। নিহতের বাবা বাদী হয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মোন্নাফ  সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।